সোমবার, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪
২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিনের একটি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী ‘মুস্তারিবিন’। হাসপাতালে অভিযান চালানো ওই গুপ্তচরেরা কয়েক দশকের চেষ্টায় ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যায়। এই বাহিনীর কর্মকাণ্ডের কিছুটা উঠে এসেছে মিডল ইস্ট আই-তে ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত রায়হান উদ্দিনের এক প্রতিবেদনে।

ফিলিস্তিনিদের বেশ ধরে যেভাবে কাজ করে ইসরায়েলি গুপ্তচর ‘মুস্তারিবিন’

কারও গায়ে চিকিৎসকের পোশাক। কেউ পরেছেন আরব মুসলিমদের লম্বা পাঞ্জাবি। আর কোনো কোনো নারী হিজাব পরে আছেন। সবার মুখে মাস্ক। ঠেলছিলেন হুইলচেয়ার। এভাবে গত ৩০ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিনের ইবনে সিনা হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছিলেন ছদ্মবেশী ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা।

ইসরায়েলের এই গুপ্তচর বাহিনী আরবিতে ‘মুস্তারিবিন’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ যারা আরবদের মতো পোশাক পরেন এবং কাজ করেন। হিব্রু ভাষায় এই বাহিনীকে বলা হয় ‘মিস্তারিভিম’। আরবি থেকেই শব্দটির উৎপত্তি।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও বেসামরিক মানুষের বেশ নিয়ে ইসরায়েলি ওই গুপ্তচরেরা হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে তিন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেন। অভিযানের সময় ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের একজন আরবিতে কথা বলেন বলে জানা গেছে।

ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে এই অভিযান চালানো হয়। সময় লাগে ১০ মিনিট।

ইসরায়েলি গুপ্তচরদের ফিলিস্তিনি বেশ নেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশেষ এই বাহিনীর এ ধরনের অভিযানে যুক্ত হওয়ার এটি সর্বশেষ ঘটনা।

এই বাহিনীর অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া যায় অনেক আগে বিংশ শতাব্দীতে, যখন ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল। ওই সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলে আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে জায়নবাদী মিলিশিয়াদের সঙ্গে কাজ করেছিল।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ এমাদ মুসা মিডল ইস্ট আই-কে বলেন, ‘মিস্তারিভিম পালমাচ ডিভিশনে একটি গুপ্তচর শাখা হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। এই ডিভিশন সন্ত্রাসী মিলিশিয়া হাগানার অংশ ছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মূলে ছিল এই হাগানা।’

মুসা বলেন, ‘মিস্তারিভিম মূলত মিজরাহি ইহুদিদের নিয়ে গঠিত, যাঁরা আরবি ভাষাভাষী দেশগুলো থেকে এসেছিলেন। জায়নবাদী আন্দোলন ও ব্রিটিশদের হয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য ফিলিস্তিনিদের (এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অন্য আরবদের) মধ্যে অনুপ্রবেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।’

এই শাখাটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও জায়নবাদী মিলিশিয়াদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেওয়ার পরে। যদিও ব্রিটিশরা একসময় তাদের পেলে-পুষে বড় করেছিল।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গোয়েন্দাগিরির একটি উপায় হিসেবে এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির বীজ বপন করতে গুপ্তচর শাখাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়।

‘উসকানিদাতা গুপ্তচর’

এ ধরনের সুপরিচিত বাহিনীগুলোর একটি হচ্ছে ‘দুভদেভান’। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ১৯৮০-এর দশকে এই বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। এটি ইসরায়েলের কয়েকটি ছদ্মবেশী গুপ্তচর শাখার একটি।

এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও গবেষক লালেহ খলিলি বলেন, ‘প্রথম ইন্তিফাদার সময় তাঁদের ব্যবহার বিশেষ করে চোখে পড়ার মতো ছিল। তাঁরা হয় দ্রুজ অথবা শিন বেতের (ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা) আরবি ভাষাভাষী ইহুদি গুপ্তচর ছিলেন।’

খলিলি বলেন, ‘(তাঁরা) গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, উসকানিদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। ভেতরে থেকে ফিলিস্তিনিদের গ্রেপ্তার কিংবা জখম বা হত্যার লক্ষ্যে বিক্ষোভ বা জমায়েতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন।’

বর্তমানে পশ্চিম তীর ও ইসরায়েলের দখলে থাকা পূর্ব জেরুজালেমে এমন ধরনের গুপ্তচর আছে। তবে গাজায় নেই। মুসা বলেন, ‘২০০৭ সালে হামাস এই উপত্যকার দায়িত্ব নিলে গাজায় নিজেদের কার্যক্রম চালানোর বেশির ভাগ সক্ষমতা হারায় মিস্তারিভিম শাখা।’

ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করে বিক্ষোভকারীদের ধরে নিয়ে যায় মুস্তারিবিন সদস্যরা। ছবি: এএফপি

মুসা বলেন, ‘গাজায় মিস্তারিভিমের কাজ চালানোর ক্ষেত্রে বন্দী হওয়া এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নাগালের অনেক বাইরে চলে যাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল।’

পশ্চিম তীরে এ ধরনের শাখাগুলোর সদস্যদের প্রায়ই ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করতে দেখা যায়। তাঁরা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে থাকে।

গ্রেপ্তার অভিযানে ছদ্মবেশী গুপ্তচরদের সরাসরি যুক্ত থাকতেও দেখা গেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন একতরফা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন গণবিক্ষোভের সময়ও তাঁরা সরাসরি এই কাজটি করেছিলেন।

‘সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা’

ইসরায়েলেও এই গুপ্তচরদের দেখা যায়। ফিলিস্তিনি আন্দোলনের কর্মীরা হাইফার মতো শহরে মুস্তারিবিনদের মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছেন। সেখানে এই বাহিনী সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিতি পেয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনিরা মুস্তারিবিনদের চিহ্নিত এবং মোকাবিলা করতে নানা কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হালকা রঙের পোশাক পরা এবং পাজামার মধ্যে জামা গুঁজে রাখা। ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা সচরাচর অস্ত্র লুকাতে গাঢ় রঙের এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরে থাকে।

মুসা বলেন, বিক্ষোভকারীরা এসব গুপ্তচরের হাতে আটক এড়াতে ছোট ছোট দলে নিজেদের সংগঠিত রাখেন। আর সন্দেহজনক ব্যক্তিদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য বিনিময় করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, কোনো কোনো সময় এসব ছদ্মবেশী গুপ্তচরকে চেনা যায়। কারণ, তারা অনেক বেশি ফিলিস্তিনি সাজার এবং ভান করার চেষ্টা করে থাকে।’

খলিলি বলেন, ‘সচরাচর ফিলিস্তিনিরা এসব গুপ্তচরের ওপর কিছুটা খেয়াল রাখতে পারেন। কিন্তু প্রায়ই অবিশ্বাস্যভাবে উত্তপ্ত প্রতিবাদের মুহূর্তে এই বাহিনীর সদস্যরা হস্তক্ষেপ করছেন, যখন ফিলিস্তিনিদের মনোযোগ অন্য দিকে থাকে।’

পশ্চিম তীরে অভিযান

মুস্তারিবিনেরা শুধু গ্রেপ্তারই করে না; তারা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার জন্যও কুখ্যাত। ২০২১ সালের মে মাসে তারা ২৪ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি আহমেদ ফাহাদকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি ছিলেন আল-আমারি শরণার্থীশিবিরের বাসিন্দা।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পরে ক্ষমা চাইতে ফাহাদের পরিবারকে ফোন করেছিলেন। তখন তাঁরা এ-ও বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপে’ জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর ভাই ও চাচাকে তাঁরা হত্যা করতে চেয়েছিলেন।

পশ্চিম তীরের শহরে শহরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ক্রমেই বাড়ছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। এসব অভিযানে ‘মুস্তারিবিন’ সদস্যরাও অংশ নিয়ে থাকে।

জানুয়ারির শুরুর দিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তুলকারম শহরে দুদিন অভিযান চালিয়ে আট ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। তারা বলেছিল, সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী, মুস্তারিবিন এবং সাধারণ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই অভিযানে যুক্ত ছিল।

নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত এই গোপন শাখাগুলোর বিক্ষোভে সাধারণ গুপ্তচরদের চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করে থাকে।

মুসা বলেন, ‘জেনিনের হাসপাতালে যা ঘটেছে, তা ভিন্ন মাত্রার একটি অভিযান। এটি ছিল সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং অনুপ্রবেশের সমন্বিত একটি অভিযান। বিষয়টি হলো এমনকি যদি এই শাখার সদস্যদের চেনা গেলেও তারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় অভিযানটি চালিয়েছিল। ফলে বেশির ভাগ মানুষই তাদের রুখে দাঁড়াতে পারেনি।’

থেকে আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছিলেন। তাঁদের সেই...

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলায় সোমবার সকালে এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে তিন...

ইসরায়েলি বাধায় এবার হজে যেতে পারেননি ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার আড়াই হাজার বাসিন্দা। সম্প্রতি মিসরের...

অভিযান চালিয়ে আসামিদের কাছ থেকে নয় কিলোগ্রাম গাঁজা ও ১০ কিলোগ্রাম ভাং জব্দ করেছিল...