একই সম্পত্তি নিজের স্ত্রী, সন্তান, ভাই, স্বজনদের নামে নামে ক্রয় ও বিক্রয় দেখিয়ে ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে নোমান গ্রুপের কর্ণধার মো. নুরুল ইসলাম। কাপড়ের কাঁচামাল আমদানি-রফতানিতে ওভার ইনভয়েস-আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশে। এসব তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়েও অদৃশ্য ইশারায় দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডকে। তবে বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান না করায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’র কাছ থেকে নথি তলব করেছেন হাইকোর্ট।
এসব ঋণ গ্রহণে ব্যবহৃত হয়েছে ৩২ প্রতিষ্ঠানের নাম। একই সম্পত্তি কোম্পানির বিভিন্নজনের নামে ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল তৈরি করে নোমান গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে নেয় প্রায় ৫শ কোটি টাকা। প্রাইম ব্যাংক থেকে ৫শ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক থেকে নেয় ২ হাজার ৪শ কোটি টাকা। লঙ্কা-বাংলা ফাইন্যান্স লি. থেকে ৫শ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক থেকে ৫শ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংক থেকে প্রায় ৮শ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৫শ কোটি, আইপিডিসি ফাইন্যান্স লি., এক্সিম ব্যাংক লি., মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক লি., মধুমতি ব্যাংক লি., বেসিক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে নোমান ফ্যাশন ফেব্রিকস লি. শত শত কোটি টাকা ঋণ নেয়।
সুফিয়া ফেব্রিকস লিমিটেড’র নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক লি., শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে কয়েকশ কোটি টাকা নেয়। ইসমাইল আঞ্জুমান আরা ফেব্রিকস লিমিটেড’র নামে অগ্রণী, ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে নেয় কয়েক শ কোটি টাকা। ঋণের টাকা এফডিআর করে সেটির বিপরীতে বিপুল অঙ্কের টার্ম লোনও নিয়েছে নোমান গ্রুপ। এ ছাড়া পুরাতন অকেজো মেশিনারীজ ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে নোমান গ্রুপ ঋণের ওপর ঋণ নিয়েছে। যা প্রদর্শিত প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মূল্যমানের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
টঙ্গি পাগাড় হাউজিং সোসাইটিতে অবস্থিত নোমান গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জাবের অ্যান্ড জুবাইয়ের ফেব্রিক্স লি. নোমান ফ্যাশন ফেব্রিক্স লি., সুফিয়া ফেব্রিক্স লি. ও ইসমাইল আঞ্জুমান আরা ফেব্রিক্স লি.। যে জমির ওপর প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থিত সেগুলোর সব দলিলই ভুয়া। এসব দলিল বন্ধক রেখে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে নোমান গ্রুপ। আর এসব আর্থিক অনিয়মের কাজে নোমান গ্রুপের কর্ণধারকে সহায়তা করেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা, বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিকটাত্মীয়, বিভিন্ন ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা এবং মধ্যম সারির অনেক কর্মকর্তা।
রেকর্ড অনুযায়ী, গাজীপুর জেলাধীন টঙ্গি থানার ১৩২ নং পাগাড় মৌজার মূল মালিক ছিলেন অমৃত লাল মজুমদারসহ ১৫ জন। এখানে ৫৮ একর ৩৬ শতাংশ জমি রয়েছে। ১৫ জন হিন্দু মালিকের কাছ থেকে টঙ্গি পাগাড় হাউজিং সোসাইটির পক্ষে আহমদ আলী ও কেরামত আলী নামক দুই ব্যক্তির নামে বেনামিতে এবং দেওয়ানি মামলা (নং-৩১৭/৬৮ইং) সোলেহনামার ডিক্রি বলে ১৯৬৮ সালের ৩০ নভেম্বর ক্রয় সূত্রে (দলিল নং-১৮৫৩৭) সূত্রে মালিক। সোলেহনামা মর্মে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির মালিক হন ১০ জন। তারা হলেন- কিউ এ হালিম ম্যানেজার, কাজী আবুল হোসেন, কাজী আব্দুস সোবহান, কাজী ফারুক হোসেন, নেওয়াজ খান, আহম্মদ আলী সরদার, কেরামত আলী, এম এ মান্নান, ড. সিরাজুল হক ও কেরামত আলী রেজিস্ট্রিযুক্ত কবলামূলে পাগাড় হাউজিং সোসাইটি থেকে অবসর নেন।
পরে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির কাজী আব্দুল হালিমসহ ৫ জন অংশীদার শেয়ার হস্তান্তর দলিলমূলে ১৯৮৯ সালের ১৭ জানুয়ারি এবং আহমদ আলী সরদার ২০০২ সালের ১৩ মার্চ আইবি দলিল (নং-আইবি-৪/২০০২) মূলে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির ১৮৫৩৭ নং দলিলের ১৬ আনা মালিকানা স্বত্ব শারমিন আক্তারের কাছে বিক্রি করে দেন। পরবর্তীতে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির বিদায়ী অংশীদার কাজী আব্দুল হালিমের ওয়ারিশরা এখন সোসাইটির মালিক শারমিন আক্তারের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা (নং-৯৫/২০০৫) করেন। এটির বাদীগণ ২০০৫ সালের ২৫ অক্টোবর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বিবাদী শারমিন আক্তার বরাবর তাদের দাবি ত্যাগ করে আর্জির তফসিলে বর্ণিত জমি থেকে চিরতরে নিঃস্বত্ববান হন। শারমিন আক্তার ১৯৮৯ সালের ১৭ জানুয়ারি শেয়ার হস্তান্তর দলিলমূলে ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে আইবি ৪/২০০২ নম্বর দলিলমূলে, গাজীপুর ১নং সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা (৯৫/২০০৫) মূলে টঙ্গি পাগাড় হাউজিং সোসাইটির ১৮৫৩৭ নং দলিলের ১৬ আনা জমির মালিক হিসেবে ভোগদখল করতে থাকেন।
এ অবস্থায় শারমিন আক্তারের স্বামী কাজী মশিউর হোসাইন (পিতা-একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসাইন) কে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির ১৮৫৩৭ নং দলিলে উল্লিখিত দাগের জমি থেকে ৩৩ একর জমি ২০০৮ সালের ১২মে হেবা দলিল (নং-৭৪৬৩) মূলে দখল হস্তান্তর করেন। ইতোমধ্যে ‘সোনার গাঁও টেক্সটাইল মিল’র মালিক আবুল কাসেম চৌধুরী সংগঠনের বিদায়ী অংশীদার ড. সিরাজুল হক থেকে একটি জাল দলিল সৃষ্টি করেন। ঢাকার উত্তরা আশকোনা নিবাসী লেহাজ উদ্দিন গং গাজীপুর জেলা ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে শারমিন আক্তারকে ২৫নং বিবাদী করে টাইটেল স্যুট (নং-৫২/২০০০) করেন। মামলাটি দো-তরফা সূত্রে ২০০৮ সালের ২১ জুলাই ডিক্রি হয়। ডিক্রিতে ২৫ নম্বর বিবাদী শারমিন আক্তারের মালিকানা চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রায়ে আবুল কাসেম চৌধুরি ও লেহাজ উদ্দিনসহ আরও কয়েকজনের মালিকানা বিলুপ্ত হয়। অন্যদিকে নোমান গ্রুপের মালিক মো. নূরুল ইসলাম আবুল কাসেম চৌধুরীর সঙ্গে যোগসাজশ করে জালিয়াতপূর্ণ সম্পত্তি নিকটাত্মীয় ইমরান আহমেদ চৌধুরীর নামে দু’টি দলিলে ‘ক্রয়’ (দলিল নং-১২৭০ ও ১২৭২) দেখান।
তার কাছ থেকে ২০০৭ সালের ২১ মার্চ এবং ২০০৭ সালের ৩১ অক্টোবর দুটি দলিলে (নং-৬৫৮২, ৬৫৮৩) নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সুফিয়া খাতুনের নামে। তার কাছ থেকে ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল আরেক সাফকবলা দলিলে (নং-৬৯২৫) নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামের স্ত্রীর ভাই শামশুল ইসলাম চৌধুরীর নামে ক্রয় দেখান। তার কাছ থেকে ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর আরেকটি দলিলের (নং-২১৭৭৮) মাধ্যমে নোমান ফ্যাশন ফেব্রিকস লিমিটেড’র পক্ষে মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম এবং লেহাজ উদ্দিনের স্ত্রী মমতাজ বেগম গংয়ের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে (দলিল নং-১৮৮৯০) মালিকানা দেখান। এই ভুয়া দলিল বন্ধক রেখেই ডাচ-বাংলা ব্যাংক লি., দিলকুশা শাখা, কৃষি ব্যাংক টঙ্গি শাখা, প্রাইম ব্যাংক, উত্তরা শাখা এবং অগ্রণী ব্যাংক প্রধান থেকে সুফিয়া খাতুন, ইমরান আহমেদ চৌধুরী ও মো. শামশুল ইসলাম চৌধুরীর নামে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়।
এই সম্পত্তি নিয়ে কাজী মশিউর হোসাইন এবং স্ত্রী শারমিন আক্তারকে বিবাদী করে সোনারগাঁও টেক্সটাইল মিলের মালিক আবুল কাশেম চৌধুরী পরে ঢাকা দেওয়ানি আদালতে আবারও মামলা (নং-৫৪/২০০৯) করেন। এতে মামলায় ৪ নম্বর বিবাদী শারমিন আক্তার ডিক্রি পান। পরে ১৭/০১/১৯৮৯ তারিখের শেয়ার হস্তান্তর দলিল, ১৩/০৩/২০০২ তারিখের আইবি-৪ নং দলিল এবং দেওয়ানি মামলা (৫২/২০০০, ৯৫/২০০৫, ৫৪/২০০৯) রায় ডিক্রিমূলে শারমিন আক্তার ও তার স্বামী কাজী মশিউর হোসাইনকে টঙ্গি পাগাড় হাউজিং সোসাইটির ১৮৫৩৭ নম্বর দলিলের ১৬ আনা মালিকস্বত্ব স্বীকার করে তাদের কাছ থেকে পৃথক দলিল (নং-৬১৫০) করে নেন মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সুফিয়া খাতুনের নামে হয় দু’টি দলিল (নং-৩৯৮২ ও ২২৫৯১)। মেয়ে নূর-ই-ইয়াছমিন ফাতেমা, পুত্র এএসএম রফিকুল ইসলাম (নোমান), মো. আব্দুল্লাহ জাবের, মো. আব্দুল্লাহ জোবায়ের, আবদুল্লাহ মো. তালহার নামে আংশিক সম্পত্তি দলিল (নং-৬১৪৯) করেন।
কাজী মশিউর ও তার স্ত্রী শারমিন আক্তারের কাছ থেকে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লি.সহ নোমান গ্রুপের আরও একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ভাড়ায় নেন। এ জমির দলিল বন্ধক রেখেও ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক লি., স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। এই সম্পত্তির ওপরই এখন জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লি. অবস্থিত। এই সম্পত্তির ওপর কাজী মশিউর হোসাইন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তারকে পাগাড় হাউজিং সোসাইটির দলিলের (নং-১৮৫৩৭) ১৬ আনা মালিক স্বীকার করে মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম এবং সুফিয়া খাতুন রিট (নং-৪৫৭২/২০১৯) করেন।
আগের ঋণের তথ্য গোপন করে নোমান গ্রুপ ১৬/০৬/২০০৫ তারিখ জাবের অ্যান্ড জোবায়ের’র নামে সম্পত্তি বিক্রি (দলিল নং-২১৯০) দেখান। দলিল রেজিস্ট্রিকালে দাতা-গ্রহিতার কলামে কোম্পানির পক্ষে পিতা মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম এবং কন্যা নূর-ই-ইয়াছমিন ফাতিমা স্বাক্ষর করেন। পরে ২১৯০ নম্বর দলিলটি ব্যবহার করে জাবের-জোবায়ের ফেব্রিকস লিমিটেড’র নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক লি., জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক লি. থেকে অন্তত ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা ঋণ নেয়।
পাগাড় হাউজিং সোসাইটির অংশীদার কাজী আব্দুল হালিমের ওয়ারিশ কাজী নাছিরুল হক গং একটি দেওয়ানি মামলায় (নং-৯৫/২০০৫) শারমিন আক্তার বরাবর তাদের দাবি পরিত্যাগ করে চিরতরে নিঃস্বত্ববান হয়ে যান। তারপরও নাসিরুল হক গং তফসিলে উল্লিখিত ৪৩৫ ও ৪৪০ দাগের সম্পত্তি দ্য খ্রিস্টান মেট্টোপলিটন হাউজিং সোসাইটি’র কাছে বিক্রি করেন। পরে দ্য মেট্টোপলিটন হাউজিং সোসাইটি এই সম্পত্তির অন্দরে কতেক সম্পত্তি মিস্টার বার্নাড অ্যান্থনি গমেজ গং এবং কতেক সম্পত্তি নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সুফিয়া খাতুনকে হস্তান্তর করেন। বার্নাড অ্যান্থনি গমেজ গং মেট্টোপলিটন হাউজিং সোসাইটির কাছ থেকে ক্রয়কৃত সম্পত্তি সুফিয়া খাতুনের কাছে বিক্রি করেন। সম্পত্তির ১৬ আনা মালিক শারমিন আক্তার-এ কথা জেনে-শুনেই মুহাম্মদ নূরুল ইসলামের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন নিঃস্বত্ববান ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্রয় দলিল করেন। ওই দলিলে ডাচ-বাংলা, সোনালী, অগ্রণী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় আরও অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা।
ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ নূরুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। নোমান গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির অনুসন্ধান নথিভুক্তি সম্পর্কে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য আমি এখনো অবগত নই। সর্বশেষ তথ্য জানা মাত্রই আপনাদের জানিয়ে দেয়া হবে।